মানি লন্ডারিং মামলায় হাজিরা দিতে আরব আমিরাতে গেলেন শেখ হাসিনা

সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহে বিশেষ আদালতে মানি লন্ডারিং মামলায় শারীরিক হাজিরা দিতে ৬ দিনের জন্য দেশটিতে গেছেন বাংলাদেশের নৈশভোটের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও ঢাকার সরকারী তরফ থেকে দাবী করা হয়েছে দুবাইর শাসকের আমন্ত্রনে গেছেন। আসলে বিষয়টি তেমন নয়, বরং শারজাহ আদালতের নির্দেশে গেছেন।
৯ই মার্চ বেলা ২টায় শারজাহ কোর্টে মানি লন্ডারিং মামলায় ভিভিআইপি আসামীর হাজিরা অনুষ্ঠিত হবে। কোর্ট লোকেশন- নূরাণী মসজিদের পার্শ্বে। মামলার নম্বর ৫২৫১। তাকে পুলিশের গাড়িতে করে (হাজতি আসামীকে যেভাবে নেয়) আদালতে নেয়া হবে। তবে এই বিশেষ আসামীর আদালতে নেয়া উপলক্ষে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও আদালতে কড়াকড়ি থাকবে। ইতোমধ্যে ৯ ইং মার্চ স্থানীয় সময় দুপুর ১:৪৫ মিনিট থেকে দুপুর ১:৫৫ মিনিট পর্যন্ত শারজাহর ইমিগ্রেশন রোড এবং দুপুর ২:১৫ থেকে ৩:৪৫ মিনিট পর্যন্ত শারজার কোর্ট এলাকার রোড, এবং ক্রাইম সিভিল কোর্ট ভবনের ২ হাজার মিটারের আশপাশ সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সূত্র মতে, ২০২০ সালে মামলা দায়েরের পর থেকে তিনি গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি মামলায় হাজিরা দিতেন। বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রপতি, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, এবং কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে তদবীর চালিয়ে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভিভিআইপি সুবিধা নিয়ে ভার্চুয়াল কোর্টে ৫/৬ দফা হাজিরা দেন। এরমধ্যে একবার হাজিরায় ২০ মিনিটের মতো থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বেরিয়ে গেছেন, তিন বার হাজির হননি, এবং দু’বার বিচার চলাকালে ‘আমি থাকতে পারবো না’ বলেই চলে গেছেন! এরপর আদালত বিরক্ত হয়ে তাকে সতর্ক করে। সতর্ক করার পরও দ্বিতীয় বার একই ঘটনা ঘটিয়েছে। মানি লন্ডারিংয়ের মত গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হয়েও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিভিআইপি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তার অপব্যবহার এবং বিচারককে অসম্মান করা হয়, যা আদালত অবমাননার সামিল। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে চুড়ান্তভাবে কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, তিনি যে ই হোন না কেনো, আগামী ৯ই মার্চ আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, নইলে একতরফাভাবেই বিচারকার্য শেষ করা হবে। সেই হাজিরা দিতেই তিনি ৭ই মার্চ বিকালে গেছেন আরব আমিরাতে।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার কন্যার সাবেক স্বামী খন্দকার মাসরুর হোসাইন মিতুর (ফরিদপুরের নূরা রাজাকারের নাতি) আরব আমিরাতে অর্থ পাচার মামলায় কন্যা পুতুল সহ শেখ হাসিনা নিজেও আসামী। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে আরব আমিরাতের শারজাহ শহরের বুহাইরা এলাকায় আল নাসির-৫ টাওয়ারের ৩০১৩ নম্বর এপার্টমেন্ট থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন মাসরুর হোসেন মিতু। তার কিছুদিন আগে হঠাৎ কাতার থেকে সাড়ে ৪ কোটি দিরহাম (যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা) অর্থ এডিসিবি ব্যাংকে জমা হয় মিতুর ব্যক্তিগত একাউন্টে। নিষিদ্ধ রাষ্ট্র কাতার থেকে এত মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের হিসাব দেখে আরব আমিরাত মানি লন্ডারিং ইউনিটকে (AML) ব্যবহার করে অনুসন্ধান চালায়। কারণ ঐ সময় কাতারের সাথে আরব আমিরাতের সকল সম্পর্ক ছিন্ন সহ সকল প্রকার চুক্তি বাতিল করেছিল আরব আমিরাত। পরে শারজাহে মিতুর ফ্লাটে তল্লাশি চালিয়ে ল্যাপটপ, আইপ্যাড, অনেকগুলো ফোন ও সিম, বিপুল পরিমানে মদ ও মাদক উদ্ধার করে পুলিশ। মিতুর পাসপোর্ট জব্দ করে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন একাউন্ট এবং ট্রানজেকশনে ৬৮০ মিলিয়ন ইউরো জব্দ করে শারজাহর AML ইউনিট। এ নিয়ে বেশ কয়েকটি মানি লন্ডারিং মামলা হয় মিতুর নামে। জিজ্ঞাসাবাদে মিতু দাবী করে, ঐ অর্থের আসল মালিক তার স্ত্রী পুতুল এবং শ্বাশুরি শেখ হাসিনা। তিনি শুধু ক্যারিয়ার মাত্র। এরপরে মিতুর মামলায় পুতুল এবং শেখ হাসিনাকে সহযোগি আসামী করা হয়। দীর্ঘদিন হাজতবাস করার পরে সম্প্রতি মিতু জামিনে বের হয়েছে। কিন্তু তার আগেই মিতুর সাথে কন্যার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটনা শেখ হাসিনা।
ফরিদপুরের কুখ্যাত নুরু রাজাকারের নাতি ও আ’লীগের সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের পুত্র খন্দকার মাসরুর হোসেন মিতু বেশ কয়েক বছর যাবৎ স্ত্রী পুতুল সহ আরব আমিরাতে বসবাস করছেন, এর আগেও মানি লন্ডরিং সহ বিভিন্ন মামলায় পড়ে কানাডা থেকে বিতাড়িত। মুলত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজেক্ট থেকে দুর্নীতিলব্ধ এবং শেখ হাসিনা ও পুতুলের কমিশন বাবদ প্রাপ্ত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাচার করে এনে ব্যাংকে রাখা, বিভিন্ন ব্যবসায় লগ্নি করা ছিল মিতুর কাজ। তার ব্যবসার মধ্যে রয়েছে হুন্ডি ব্যবসা, বিভিন্ন দেশ থেকে কালো টাকা আদান-প্রদান।
আরব আমিরাতের ৭টি আমিরাতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শারজাহ আমিরাতের আইন কানুন অন্য আমিরাতগুলি থেকে আলাদা। এখানে শরীয়া আইন কার্যকর। তাছাড়া ২০১৮ সালে নতুন এন্টি মানি লন্ডারিং আইন (AML) কার্যকর করার পর থেকে দেশটিতে মানি লন্ডারিং ড্রাইভ জোরদার হয়। সেই আইনী বিপদেই পড়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মেয়ের সাবেক জামাই, এবং তার সাথে বিনাভোটের প্রধানমন্ত্রী এবং তার কন্যা। ঘটনা ঘটার পরে মামলা যাতে না হয় সেই চেষ্টা করতে ২০০০ সালের ১১ জানুয়ারী শেখ হাসিনা নিজেই ছুটে যান আরব আমিরাতে (যদিও ২ মাস আগেই আমিরাত সফর করেছিলেন)। আরব আমিরাতের শাসক পরিবারকে ব্যবহার করার তদবীর করেন, এমনকি আরব আমিরাতের জাতির মাতা শেখা ফাতিমাকে ‘মা’ ডেকে তাঁর মাধ্যমে তদবীর চালিয়েও কোনো সুবিধা করতে পারেননি। ঐ সময় ঢাকায় নিযুক্ত ইউএই রাষ্ট্রদূত আলমেহিরিকে দেশে পাঠিয়ে তদবীর চালান শেখ হাসিনা, কিন্তু উল্টো ফল হয়, আলমেহিরি চাকরি হারান, এবং বাংলাদেশে আর ফিরতেই পারেননি। জানা গেছে, শারজাহর শাসক শেখ সুলতান বিন মুহাম্মদ আল কাসিমি নিয়মনীতিতে খুব কড়া, দ্বিতীয়ত শারজাহ শাসকের সাথে কেন্দ্রের শাসকের সম্পর্ক ভালো না। ফলে শেখ হাসিনা দুবাই শাসকের মাধ্যমে তদবীর চালিয়ে কোনো সুবিধা করতে পারেননি। কেবল, একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভার্চুয়াল হাজিরার সুবিধা লাভ করেছিলেন, কিন্তু তা বরখেলাপ করায় বর্তমান ব্যক্তিগত হাজিরার সম্মুখীন।